ডায়াবেটিক রোগীর রমজানের প্রস্তুতি।
বর্তমানে ডায়াবেটিস সম্পর্কে ভালোভাবে জানাকেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয়। এজন্য কোন কোন অবস্থায় রোজা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতে হবে এবং কোন প্রকার জটিলতা দেখা দিলে তা কিভাবে সমাধান করতে হবে তা রোগী ও তার পরিবারের সদস্যদেরকেও রমজানের পূর্বেই শিখতে হবে।
মনে রাখতে হবে, সবার জন্য একই ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়। প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা অনুসারে আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রমজানের পূর্বেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরী।
রমজান মাসের রোজার সময় রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য রোগীর কি কি করণীয় সে সম্পর্কে চিকিৎসক আপনাকে পরামর্শ দিবেন। বিশেষ করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া যাতে না সেজন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
ডায়াবেটিক রোগীদের সার্বিক কল্যাণের জন্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রচার মাধ্যমগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
আপনি যদি রোজা রাখা মনস্থির করে থাকেন, অবশ্যই রোজা শুরুর ২/৩ (কমপক্ষে ১ মাস) মাস আগেই প্রস্তুতি নিবেন ও ডাক্তার এর পরামর্শ নেবেন। মনে রাখবেন মহান আল্লাহ্ আপনার জন্য রোজা যেমন ফরজ করেছেন, তেমন অসুস্থতার অসুস্থতার কারনে রোজা না রাখার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।
ডায়াবেটিস রোগের ডাক্তার অথবা আপনার চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিবেন, আপনার স্বাস্থ্য রোজা রাখার উপযুক্ত কিনা তা অবশ্যই একজন আলেম/ধর্মীয় জ্ঞান সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করাই ভালো।
যদি রোজার জন্য আপনি উপযুক্ত হয়ে থাকেন, অবশ্যই আপনার ডাক্তার ডায়াবেটিস-এর ঔষধ/ ইনসুলিনের মাত্রা পরিবর্তন করে দিবেন এবং আপনি তা মেনে চলবেন।
মুখে খাবার ঔষধ:
রমজানের প্রথম ও শেষ দিন ঔষধকে বিশেষ করে সমন্বয় করে নিতে হবে।
যারা দিনে ১ বার ডায়াবেটিসের ঔষুধ খান (যেমন: সালফোনাইল ইউরিয়া দিনে ১ বার), তারা ইফতারের শুরুতে ঐ ঔষুধ একটু কম করে খেতে পারেন।
যারা দিনে একাধিক বার ডায়াবেটিসের ঔষুধ খান (যেমন: সালফোনাইলইউরিয়া দিনে ২ বার), তারা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে রাতের মাত্রাটি অর্ধেক পরিমানে সেহরির আধা ঘন্টা আগে খেতে পারেন।
যারা মেটফরমিন ৫০০/৮৫০ মিলিগ্রাম দিনে ৩ বার গ্রহন করেন, তারা ইফতারের পর মেটফরমিন ১০০০ মিলিগ্রাম এবং সেহরির পর ভরা পেটে ৫০০/৮৫০ মিলিগ্রাম খেতে পারেন।
যারা রিপাগ্লিনাইড অথবা নেটিগ্লিনাইড গ্রহন করেন, তারা ইফতারের শুরুতে ও সেহরির আগে খেতে পারেন অথবা সন্ধ্যারাতে খাবারের আগে খেতে পারেন।
ইনসুলিন:
যারা ৩ বার ইনসুলিন গ্রহন করেন:
ইফতারের সময় : সকালের পুরো ডোজ নিবেন।
সন্ধ্যারাতে : দুপুরের পুরো ডোজ নিবেন।
সেহরির সময় : রাতের অর্ধেক ডোজ নিবেন।
যারা ৩ বার (Short acting ) ইনসুলিন এবং রাতে (NPH) গ্রহন করেন:
ইফতারের সময় : সকালের পুরো ডোজ নিবেন।
সন্ধ্যারাতে : দুপুরের পুরো ডোজ নিবেন।
সেহরির সময় : রাতের অর্ধেক ডোজ নিবেন।
যারা ২ বার ইনসুলিন গ্রহন করেন:
ইফতারের সময় : সকালের পুরো ডোজ নিবেন।
সেহরির সময় : রাতের অর্ধেক ডোজ নিবেন।
যারা ১ বার ইনসুলিন গ্রহন করেন: তারা ইফতারের সময় নিবেন।
আধুনিক ইনসুলিন (Analogue, Degludec) চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেওয়া যেতে পারে। এতে হঠাৎ করে রক্তের সুগার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তারপরও রক্তের সুগার পরীক্ষা করে মাত্রা ঠিক করা উচিৎ।
জেনে রাখা ভালো (বিভিন্ন আলেম-ওলামার মতামত) রোজার সময় রক্ত পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে ইনসুলিন নিলেও রোজা ভাঙ্গবে না।
সেহরাীর ২ ঘন্টা পর, দুপুর ১২টা-৩ টা, ইফতারের আগে, এবং ইফতারের ২ ঘন্টা পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিৎ।
রোজার সময় অতিরিক্ত ব্যায়াম করার দরকার নেই। তারাবীর নামাজ অনেকটাই ব্যায়াম এর প্রয়োজনীয়তা পুরণ করে থাকে। তবে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য আরো কিছুটা হাঁটা যেতে পারে। তবে সেটা অবশ্যই ইফতার এর পর।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমানে (২.৫-৩.০ লিটার) পানি খাবেন। বিশেষত: গ্রীষ্মকালে পানি শূন্যতার (Dehydration) সম্ভাবনা বেশী।
সেহরীর খাবার যতটা সম্ভব শেষ সময় খাওয়ার চেষ্টা করবেন।
খেজুর/সরবত না খাওয়ার চেষ্টা করবেন। তবে অৎঃরভরপরধষ ঝবিবঃবহবৎ Artificial Sweetener (Aspartame, Sucralose) কমমাত্রায় খাওয়া যেতে পারে।
ইফতারের সময় ভাজা পোড়া, তৈলাক্ত জিনিস কম খাওয়া ভালো। ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টক দই তালিকাভুক্তি করতে পারেন। কচি (শাস ছাড়া) ডাবের পানি পান করতে পারেন। শশা, খিরা, আমরা, কচি পেয়ারা, লেবুর পানি (চিনি ছাড়া) ও অন্যান্য টক ফল ইচ্ছামত খাওয়া যাবে।
রোজা ভাঙ্গা আবশ্যক যখন হাইপো লক্ষণ এবং রক্তে গ্লুকোজ খুব কম হয়। সেহরীর ২-৩ ঘন্টা পর ৪.০ মিলিমোল/লি (৭২ মিলিগ্রাম/ডিএল) এর কম হলে অথবা দিনের যেকোন সময় ৩.৩ মিলিমোল/লি (৬০মিলিগ্রাম/ডিএল) এর কম হলে রোজা ভাঙ্গতে হবে। যদি রক্তে গ্লুকোজ এর পরিমান বেড়ে ১৬.৭ মিলিমোল/লি (৩০০ মিলিগ্রাম/ডিএল) হয়ে যায়, তবে প্রস্রাবে কিটোন বডি পরীক্ষা করতে হবে এবং জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা সবাইকে সুস্থ রাখুন ও রোজা রাখার তওফিক দান করুন। আমীন।
রোজার সময় রক্ত পরীক্ষা এবং প্রয়োজনে ইনসুলিন নিলেও রোজা ভাঙ্গবে না। এই মর্মে আলেমদের মতামত দেওয়া হল।
মিশরীয় ফতোয়া বিভাগ
(তোমরা কোন বিষয়ে না জানলে তা তোমরা আহলে জিকির অর্থাৎ ফিকাহ্বিদকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও)
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তায়ালার জন্যই নিবেদিত এবং দুরূদ ও সালাম আমাদের নেতা আল্লাহ্ রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর উপর বর্ষিত হোক যাঁর পরে আর কোন নবী নেই এবং বর্ষিত হোক তাঁর পরিবার বর্গের উপর, সাহাবা কেরামদের উপর, তাঁর অনুসারীদের উপর বিশুদ্ধভাবে কিয়ামত পর্যন্ত।
আমরা বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগ সম্পর্কিত বিষয়ে মিশরীয় চিকিৎসক সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অবগত হই যার নিবন্ধন নং ১৫৮৯, ২০০৬ সালে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
ডায়াবেটিক রোগী রোজা রাখা অবস্থায় চমড়ার নীচে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিলে তাতে রোজার কি কোন ক্ষতি হবে?
উত্তরঃ
না, কোন ক্ষতি হবে না। রোজাদার চামড়ার নীচে ইনসুনি ইনজেকশন নিলে রোজা নষ্ট হয় না। তবে রোজাদার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা উদরে, খোলা লোমকূপে, রক্তবাহী রগের ভিতর, এমন কিছু পৌছায় যার দ্বারা চেতনা লোপ পায় তা হলে রোজা নষ্ট হবে, রোজার ক্ষতি হবে।
আল্লাহ্ই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ফতোয়া বিভাগ
এমাদউদ্দিন আহমদ-ইফত আব্দুল আহমদ মুহাম্মদ
২০/০৬/২০০৬
ডা. এম. এম. রহমান রাজীব
picture :Photo by Igor Ovsyannykov on Unsplash
[…] […]